
বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাবান রাষ্ট্র আমেরিকার সব প্রতিরক্ষাবিষয়ক
কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবেই পৃথিবীর কাছে পরিচিত পেন্টাগন। যেন এখান
থেকেই নিয়ন্ত্রণ হয় গোটা বিশ্ব। পেন্টাগনের নিজস্ব গোপনীয়তা এতই কঠোর
যে, পর্দার আড়ালের খবর কখনোই পুরোটা জানা সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন সময়
বিভিন্ন প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা এবং পরিচালনার জন্য প্রত্যক্ষ ও
পরোক্ষভাবে পেন্টাগনকেই দায়ী করা হয়। আমেরিকার ব্ল্যাক বাজেট প্রণয়ন ও
খরচের পেছনে যেমন পেন্টাগনের হাত রয়েছে, তেমনি আফগানিস্তান, ইরাকে
পরিচালিত যুদ্ধের সরাসরি নির্দেশনাও এসেছে এখান থেকেই। এজন্য ৯/১১ হামলাতেও
আক্রান্ত হয়েছিল পেন্টাগন। সেই পেন্টাগনের বহুল আলোচিত ও সমালোচিত
বিষয়গুলো নিয়ে লিখেছেন-
বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ:

পেন্টাগন মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের সদর দফতর। এখান থেকেই পুরো বিশ্ব
নিয়ন্ত্রণ হয়। বিভিন্ন যুদ্ধ পরিচালনার জন্য প্রাথমিক পরিকল্পনা করা হয়।
সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেসব সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে,
সেসবের মূল পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা এই পেন্টাগন। এটি যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া
অঙ্গরাজ্যের আর্লিংটনে (৪৮ এন রোটারি রোড, আর্লিংটন) অবস্থিত। এর চিঠি
লেখার ঠিকানা ওয়াশিংটন, ডিসি ২০৩০ পেন্টাগনের নির্মাণকাজ শুরু হয় ১১
সেপ্টেম্বর ১৯৪১, আর শেষ হয় ১৫ জানুয়ারি ১৯৪৩ সালে। এর মোট জমির পরিমাণ
৫৮৩ একর। ভবনটির উচ্চতা ২৪ মিটার। এখানে মোট সিঁড়িপথ ১৩১টি, এস্কেলেটর
১৯টি, এলিভেটর ১৩টি, বিশ্রাম কক্ষ ২৮৪টি এবং জানালা রয়েছে ৭৭৫৪টি। ইউ এস
সামরিক ব্যক্তিবর্গ উপরস্থ কর্মকতাকে অভিবাদন এবং অবশ্যই টুপি পরিধান করেন।
মধ্যবর্তী খোলা চত্বর অনানুষ্ঠানিকভাবে গ্রাউন্ড জিরো " নামে পরিচিত।
ঠাণ্ডা যুদ্ধের সময় এই ডাকনাম সৃষ্টি হয়েছিল। যখন এটিকে একটি নিউক্লিয়ার
মিসাইলের সর্বাপেক্ষা সম্ভাব্য নিশানা হিসেবে চিন্তা করা হয়েছিল। এই
চত্বরের মধ্যে গ্রাউন্ড জিরো ক্যাফে নামে একটি স্নাঙ্ বার আছে। স্থাপনা
হিসেবে পেন্টাগন যতটা গুরুত্বপূর্ণ তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র
পরিচালনায় নিয়োজিত প্রায় সব নেতৃস্থানীয় কর্তাব্যক্তিদের উপস্থিতির
জন্য। পেন্টাগনে প্রবেশ সাধারণের জন্য প্রায় নিষিদ্ধ। এর ভেতরে ফটোগ্রাফি
এবং ভিডিওগ্রাফির জন্য প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমতির প্রয়োজন
হয়। পেন্টাগণের ভেতরের ছবি তাই অনেকেই দেখতে পারেন না। শুধুমাত্র সেমিনার
হল এবং বিভিন্ন প্রেসের কর্মকাণ্ডের জন্য নির্দিষ্ট স্থান থেকেই এর কাজ
চালানো হয়। বিশ্ব নিয়ন্ত্রণের অনেক গোপন তথ্য জমা আছে এখানে।
পেন্টাগনে হামলা:

৯/১১ হামলায় আক্রান্ত হয়েছিল পেন্টাগন। আমেরিকান এয়ার লাইন্সের ফ্লাইট
৭৭ সরাসরি আঘাত করে পেন্টাগনে। সকাল ৮.২০ মিনিটে ছেড়ে যায় এই ফ্লাইটটি।
এর ভেতরে ৬ জন ক্রু ছাড়াও ৫৩ জন যাত্রী ছিলেন। এই বিমানটিতে ছিল ৫ জন
ছিনতাইকারী। তারা বিমানটি ছিনতাই করার পর জোরপূর্বক পেন্টাগনের দিকে নিয়ে
চলে। সকাল ৯-৩৭ মিনিটে, পেন্টাগনে যখন বিমানটি আছড়ে পড়ে তখন এদের সবাই
নিহত হয়েছেন। এই হামলার দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করা সম্ভব হয়েছিল। একটি
সিসি টিভি ক্যামেরার মাধ্যমে ৮৬ সেকেন্ডের সেই ফুটেজে বিমান ছিনতাইকারীদের
কবলে পড়ে কীভাবে পেন্টাগনে আঘাত হানে সেটা পুরো বিশ্ব দেখেছে। আঘাত করার
পরপরই পেন্টাগনে আগুন লেগে যায়। ভেঙে পড়ে এক অংশ। এর ফলে নিহতের সংখ্যা
আরও বাড়তে থাকে। ভবনের দক্ষিণ দিকে আঘাত করার পরপরই সেখানে ছুটে যায়
অগি্ননির্বাপণ কর্মীরা। খুব নিখুঁত পরিকল্পনা মোতাবেক পেন্টাগনে হামলা
হয়েছে বলে মত দিয়েছেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের গবেষকরা। তবে এই হামলা
সফল হয়েছে বলে ধরা হয়। ফুটেজে দেখা গিয়েছিল বিমানটি পেন্টাগনে একটি ব্লক
ধসিয়ে দেওয়ার আগে রাস্তার ল্যাম্প পোস্টের গায়ে বাড়ি খায়। এর ফলে
বিমানের একটি ডানা ডানদিকে বেঁকে গিয়ে পেন্টাগনে আঘাত হানে। পেন্টাগনে
বিমানটি আঘাত করার পর ফাস্ট ফ্লোর লেভেলটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়।
বিমানের ফুয়েল ট্যাংক এখানেই ভেঙে পড়ায় অতি উচ্চ তাপমাত্রায় আগুন
জ্বলতে থাকে। এই আগুনের ধোয়া কয়েক মাইল দূর থেকে দেখা গিয়েছিল।
প্রধান নিরাপত্তা কার্যালয়:

আমেরিকার প্রধান নিরাপত্তা কার্যালয়টি রয়েছে পেন্টাগনে। ইউএসের সব
প্রতিরক্ষাবিষয়ক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ধরা হয় পেন্টাগনকে।
এখান থেকেই প্রতিরক্ষাবিষয়ক দলগুলোর সমন্বয় এবং বিভিন্ন গোপন সংস্থার
কর্মকাণ্ডকে পরিচালিত হয়। এর অনেক কিছুই সরকারের উচ্চপদস্থ সিদ্ধান্ত।
সিদ্ধান্ত মোতাবেক হলেও এমন অনেক বিষয় রয়েছে যেগুলোর সম্বন্ধে বাইরের
পৃথিবীকে মোটেও জানানো হয় না। ন্যাশনাল সিকিউরিটি এবং ইউএস আর্মড ফোর্স
সরাসরি পেন্টাগন থেকেই নিয়ন্ত্রণ হয়। পেন্টাগনের ভেতরেই প্রধান
প্রতিরক্ষা কার্যালয় থাকায় এখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা সবচেয়ে জোরালো।
শত্রুদেরও সবসময়ই মূল লক্ষ্যস্থল হয় পেন্টাগন। পেন্টাগনে অসংখ্য অফিস
রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে। তাদের সংখ্যা ২.১৩ মিলিয়ন। এর মধ্যে
রয়েছে সৈনিক, নাবিক, বিমান বাহিনী, নৌবাহিনীতে কর্মরত বিভিন্ন কর্মকর্তা।
সেনা, নৌ, ও বিমান বাহিনীর পাশাপাশি মেরিন রিজার্ভ হিসেবেও রয়েছে অনেকে।
এদের সবার অফিস এই পেন্টাগনে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা আরও
কিছু গোপন সংস্থার অফিসও রয়েছে পেন্টাগনে। এদের মধ্যে ডিফেন্স
ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি, ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি, ডিফেন্স অ্যাডভান্স
রিসার্চ প্রজেক্ট এজেন্সি, ডিফেন্স লজিস্টিক এজেন্সি, মিসাইল ডিফেন্স
এজেন্সি, পেন্টাগন ফোর্স প্রোটেকশন এজেন্সি ছাড়াও আরও অনেক সংস্থা রয়েছে।
এদের সবার কাজই ভীষণ গোপনীয়তা রক্ষা করা হয় এ পেন্টাগন থেকে।
গোপন সুড়ঙ্গ:

আমেরিকার প্রধান প্রতিরক্ষা কার্যালয় পেন্টাগনে থাকায় এটির নিরাপত্তা
ব্যবস্থাও নজিরবিহীন। এত বিশাল কর্মযজ্ঞের স্থান পেন্টাগন যে, সেখানে
প্রবেশে রয়েছে অনেকগুলো রাস্তা। তবে আপদকলীন সময়ে পেন্টাগন থেকে শহরের
অন্য কোথাও যেতে হলে যেতে হবে মাটির নিচে সুড়ঙ্গ দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের
অন্যতম বৃহৎ টানেল সড়কের সঙ্গে যুক্ত আছে পেন্টাগন। এসব সুড়ঙ্গ দিয়ে
আমেরিকার মূল শহরের যে কোনো জায়গায় চলে যাওয়া যায় সহজেই। কিন্তু এই
সড়কগুলো শুধু পেন্টাগনের নিজস্ব গোপন বিষয়। এসব সড়কে সাধারণ মানুষ চলাচল
করা দূরে থাক, ঠিকানা পর্যন্ত জানে না অনেকে। পেন্টাগন থেকে বের হওয়ার
জন্য টানেলগুলোর শুরুর দরজা চেনার উপায় নেই। কিছু কিছু টানেলের দরজা
রয়েছে নেতৃস্থানীয় কর্তাদের টেবিলের নিচ দিয়ে, কিছু টানেলের দরজা রয়েছে
দেয়ালের পেছনে লুকানো। এসব তথ্য পুরোপুরি সঠিক জানে না কেউ। তবে হোয়াইট
হাউসের টানেল যোগাযোগ ব্যবস্থার একটি মানচিত্র থেকে জানা যায়, পেন্টাগনের
সঙ্গে কীভাবে যোগ আছে পুরো শহর। ইচ্ছা করলেই যে কেউ পেন্টাগন থেকে সিআইএর
সদর দফতর, হোয়াইট হাউস, এফবিআই সদর দফতর, নাসার সদর দফতরে যাওয়া সম্ভব।
এসব গোপন সুড়ঙ্গ শুধু আপদকালীন সময়েই ব্যবহার করা হয়। সত্যিকারের
যোগাযোগ ব্যবস্থার পুরো চিত্র কখনোই হয়তো জানা যাবে না। পেন্টাগনের যত
গোপন বিষয় রয়েছে, তার মধ্যে গোপন সুড়ঙ্গ ব্যবস্থা একটি। গোপন
সুড়ঙ্গগুলো সবসময়ই আইনশৃঙ্খলা কর্মীদের নিয়ন্ত্রণে থাকে বলে এ সম্পর্কে
তথ্য সংগ্রহ করা প্রায় অসম্ভব।
ব্ল্যাক বাজেট:

পেন্টাগনের ব্ল্যাক বাজেটের পরিমাণ সঠিক জানা যায়নি কখনো। তবে সেটার
পরিমাণ ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চেয়ে অনেক বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বড়
অংশই খরচ হয় আমেরিকার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন ও বিভিন্ন গোপন
মিশনের জন্য। আমেরিকার অর্থনীতির সিংহভাগ গোপনে খরচ করার জন্য ব্ল্যাক
বাজেট সবচেয়ে বড় খাত। পেন্টাগনের বিভিন্ন গোপন অভিযান চালানোর জন্য এই
বাজেট ব্যবহার করা হয়। বাজেটের আরেকটি অংশ ব্যয় হয় গোয়েন্দা
কার্যক্রমের জন্য। এই কার্যক্রম আমেরিকার ভেতরেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন
দেশেও কাজে লাগানো হয়। এছাড়া আরও কিছু খাতে এই বড় অঙ্কের বাজেট কাজে
লাগে। বিভিন্ন স্পেশাল অভিযানের জন্য রাখা হয় বাজেটের একটি অংশ। সুপার
সিক্রেট ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি নামে একটি প্রোগ্রাম পরিচালনা করা হয়
এই বাজেট দিয়েই। নাসাকে দিয়ে পরিচালিত মানুষের অজানা বিভিন্ন উপগ্রহ তৈরি
ও উৎক্ষেপণের কাজেও ব্ল্যাক বাজেট রয়েছে। এসবই পেন্টাগনের নিজস্ব
তত্ত্বাবধানে হয়ে থাকে। পেন্টাগনের ভেতরেই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাই সরাসরি
এসব পরিকল্পনা করেন এবং বাস্তবায়ন করেন। বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র উন্নয়ন এবং
নতুন নতুন মিশাইল আবিষ্কারের জন্যও পেন্টাগনে বসে খরচের খাত। আর এই খরচটির
পুরোটাই জোগান দেয় ব্ল্যাক বাজেট। এই বাজেট কীভাবে ছাড় পায় তা জানে না
কেউই। অনির্ধারিত খাত হিসেবে আরও কত খরচ হয় সেটি একমাত্র পেন্টাগনই জানে।
পেন্টাগনের এই বাজেট তৈরি করতে কোনো সমস্যাই হয় না। পেন্টাগনের মোট খরচের
খাত এত বড় অঙ্কের এবং এতগুলো বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে যে, খুব সহজেই এই
টাকার খাত সৃষ্টি করা সম্ভব হয়।
ইন্টারনেট যুদ্ধ:

posted by BIKRAM
No comments:
Post a Comment